শেখ মোহাম্মদ রতন, সমকালীন মুন্সীগঞ্জ ডেক্স, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১:
মুন্সীগঞ্জ জেলা শহর ও শহরতলীর প্রায় সব সড়ক এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মিশুকের দখলে। শহরজুড়ে অবৈধভাবে চলছে এসব যানবাহন। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের সনদ ছাড়াই সড়কের জায়গা দখল করে যত্রতত্র তৈরি করা হচ্ছে এসব যানবাহন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু মুন্সীগঞ্জ ও মীরকাদিম পৌরসভাতেই রয়েছে এসব অবৈধ যানবাহন তৈরির প্রায় দেড় শতাধিক কারখানা। অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু শীর্ষ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে গড়ে উঠেছে কারখানাগুলো।
জেলার ছয়টি উপজেলায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এসব কারখানার মালিক রাতারাতি হয়ে গেছে বিপুল অর্থের মালিক।
জানা যায়, মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলাসহ ছয়টি উপজেলায় দুই সহস্রাধিক অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মিশুক চলছে।
এসব পরিবহনের বেপরোয়া গতির কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রতিদিন নানা ধরনের দুর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছেন। ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহনের মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ার কারণে জনগণ প্রতিবাদ করেও কোনো সুফল পাচ্ছেন না।
তাছাড়া পুলিশ-প্রশাসনের অনেকে গ্যারেজ মালিকদের কাছে থেকে প্রতি মাসে মাসে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে এসব অবৈধ যান চলাচলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব কারখানায় স্যালো ইঞ্জিন দিয়ে তৈরি করা যানবাহনের কোনো বৈধ সরকারি অনুমতিপত্রও নেই। নেই পরিবেশ ছাড়পত্রও।
স্থানীয়দের মতে, এসব কারখানাগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসনের তদারকিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা দরকার। প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করাসহ কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেলা শহরের উত্তর ইসলামপুরে রয়েছে অর্ধ-শতাধিক গ্যারেজ। দক্ষিণ ইসলামপুরেও অনেক গ্যারেজ রয়েছে।
এছাড়া জেলা শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ডসহ শহরের অলিতে-গলিতে রয়েছে অর্ধশত অটোরিকশা তৈরির কারখানা।
এদিকে ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহনের ব্যাটারি চার্জ দেয়ার জন্য গ্যারেজ তৈরি করে অবৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হচ্ছে। আর অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ দিতে রয়েছে প্রতিটি উপজেলায় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
মূলত লেনদেন হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এতে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের সদর জোনাল অফিসের ডিজিএম শফিউল আলম বিদ্যুৎ বিতরণের ক্ষেত্রে এসব অবৈধ সংযোগের অভিযোগ অনিয়মের সত্যতা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে এর তদারকি করছি। আশা করছি খুব দ্রুতই বৈধ সংযোগ নিয়ে অবৈধ পন্থায় বিদ্যুৎ চুরির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের যারা টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ দিচ্ছে, তাদের শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
কারখানার শ্রমিকরা জানান, তারা ট্রাফিক পুলিশ-প্রশাসনসহ পল্লী বিদ্যুৎ অফিস ও জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা দেন।
তারা বলেন, ‘আমরা প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫টি ইঞ্জিন ভ্যান, ব্যাটারিচালিত অটোভ্যান, মিশুক, নসিমন, করিমন তৈরি করি। একটি ইঞ্জিনভ্যান তৈরি করলে খরচ বাদে মালিকের লাভ হয় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।’
মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার এএইচএম মোবারক উল্লাহ বলেন, ‘জেলা সদর উপজেলাসহ ছয়টি উপজেলার মধ্যে প্রায় এক হাজার ব্যাটারিচালিত অটোগাড়ির গ্যারেজ রয়েছে।
এসব গ্যারেজে বৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে অবৈধভাবে ব্যাটারি চার্জ করছে। এটা আমি ব্যক্তিগতভাবে অবগত। গত ছয় মাসে বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক টিম করে দিয়েছি।
তারা চিরুনি অভিযান চালিয়ে গজারিয়া ছাড়া বাকি পাঁচ উপজেলার শতাধিক অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ জরিমানা আদায় করেছে।’
মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ফয়সাল বিপ্লব বলেন, ‘ব্যটারিচালিত এসব অটোগাড়ি ও মিশুকের কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ রাস্তায় চলাচল করতে ভয় পায়। প্রতিদিনই সাধারণ মানুষ এসব যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। আমি পৌর মেয়র হয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারসহ সুশীল সমাজের মানুষকে এ বিষয়ে দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করছি।’
এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার ভূমি শেখ মেজবাউল সাবেরিন বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জের সবখানে এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ইঞ্জিনচালিত থ্রি-হুইলার বা এ ধরনের যানবাহন মহাসড়কে চলার কোনো অনুমতি নেই।
এগুলো এভাবে তৈরি করারও কোনো নিয়ম নেই। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। এর বিরুদ্ধে অবশ্যই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।’
সহকারী পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ নাজমুল রায়হান বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জ সদরে ব্যাটারিচালিত অবৈধ মিশুক, অটোরিকশা বেড়েই চলেছে। এসব অবৈধ যানবাহনের এখনই গতিরোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে শহর ও শহরতলির রাস্তা দিয়ে সাধারণ মানুষ হাটা-চলা করতেও পারবে না।
মুন্সীগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্য যদি টাকা নিয়ে থাকে, অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এ বিষয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘জেলায় এসব ব্যাটারিচালিত মিশুক, অটোগাড়ির চলাচলের কোনো সরকারি অনুমোদন নেই।
সেজন্য ছয়টি উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে জরুরি সভা করে ব্যাটারিচালিত মিশুক, অটোগাড়ির বিষয়ে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ এসব বাহনের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিলে সঠিক সমাধান সম্ভব বলে জানান তিনি।
এদিকে, মুন্সীগঞ্জ সদরসহ ছয়টি উপজেলার সর্বত্র এলাকাজুড়ে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার যন্ত্রণাদায়ক হর্নের বিকট শব্দের অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে হাটবাজারসহ রাস্তায় চলাচল করা মানুষ। দিনের পর দিন শব্দদূষণে ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে। প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তারা। এ বিষয়ে অটোরিকশাচালক জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, ‘অটোরিকশার গতি বেশি থাকে। সে কারণেই এত বিকট শব্দে হর্ন বাজাতে হয়।’
জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আব্দুল মোমেন বলেন, ‘অটোরিকশা, মিশুক, নসিমন-করিমনগুলোর বিধিমালা প্রয়োগ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্দেশ দিলেও চালকরা তার কোনো তোয়াক্কা করছে না। তবে প্রতিনিয়ত পুলিশ সদস্যরা চেষ্টা করে যাচ্ছে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণসহ অবৈধ ব্যাটরিচালিত এসব যানবাহন স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য।’