শেখ মোহাম্মদ রতন, সমকালীন মুন্সীগঞ্জ:-১১-১২-১৯:
মুন্সীগঞ্জ মুক্ত দিবস আজ। একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে হানাদার মুক্ত হয়েছিল মুন্সীগঞ্জ।
দিবসটিতে আজ মুন্সীগঞ্জে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
এ উপলক্ষে রাত ১২ টা ১ মিনিটে ৪৮ টি ফানুস উড়িয়ে হানাদারমুক্ত দিবস উদযাপন করে মুন্সীগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড। মুন্সীগঞ্জ শহরের অংকুরিত একাত্তর ভাস্কর্য এর সামন থেকে এই ফানুস উড়ানো হয়।
এ সময় মুন্সীগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড এর আহ্বায়ক জালাল উদ্দিন রাজন এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো: আনিসুজ্জামান আনিস।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুন্সীগঞ্জ পৌর মেয়র হাজী মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব, মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ খোকা প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণের পর থেকেই মুন্সীগঞ্জ জেলায়ও গর্জে উঠেছিল মুক্তিকামী জনতা। ২৯ মার্চ ছাত্র জনতা মুন্সীগঞ্জ অস্ত্রাগার লুট করে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। জেলাটি ঢাকার সন্নিকটে হওয়ায় মুন্সীগঞ্জের প্রতি পাক সেনাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। পহেলা মে পাকসেনা দল ধলেশ্বরী নদী পার হয়ে শহর ও আব্দুল্লাহপুর লঞ্চঘাট দিয়ে ঢুকে পরে মুন্সীগঞ্জে।
প্রবেশের পর হানাদাররা সরকারি হরগঙ্গা কলেজে তৈরি করে তাদের প্রধান ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে নির্যাতন-হত্যা চালানো হতো। হত্যা করে কলেজের পূর্ব পাশে বধ্যভূমিতে ফেলে রাখতো লাশ। ক্যাম্পে বসেই নীলনকশার মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যাসহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাক সেনারা। পরিশেষে জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধ যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, ক্রমেই কোনঠাসা হতে থাকে পাক হানাদার বাহিনী। অবশেষে প্রতিটা জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত এবং কঠিন প্রতিরোধের কারণে ১০ ডিসেম্বর গভীর রাতে মুন্সীগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়। গা ঢাকা দেয় পাক বাহিনীর দোসর রাজাকাররাও।
একাত্তর সালে মুন্সীগঞ্জ ছিল ঢাকা জেলার একটি মহকুমা। নদীবেষ্টিত গজারিয়া থানা মুন্সীগঞ্জের অন্তর্গত হলেও মূলত এটি ছিল একটি বিচ্ছিন্ন এলাকা। ৮ মে মধ্যরাতে একজন পাকিস্তানি মেজরের নেতৃত্বে বেলুচ রেজিমেন্টের দুই শতাধিক সেনা গজারিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। পরদিন ৯ মে ভোর বেলায় এক ভয়াবহ অভিযান শুরু করে। এটিই মুন্সীগঞ্জের প্রথম গণহত্যা। বর্বর হানাদার বাহিনী গজারিয়া উপজেলার ফুলদী নদীর উপকণ্ঠের গ্রামগুলোতে নারকীয় অভিযান চালিয়ে তিন শতাধিক নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। ওই দিনই সকাল বেলা হানাদার বাহিনী নৌপথে মুন্সীগঞ্জ শহরে অনুপ্রবেশ করে। ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের মেজর আবদুস সালামের নেতৃত্বে দুই শতাধিক সৈন্যের একটি কোম্পানি মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে ঘাঁটি স্থাপন করে। মুন্সীগঞ্জে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট পাঠানো হয় মূলত গণহত্যা পরিচালনার জন্য।
একাত্তরে হানাদার বাহিনী মুন্সীগঞ্জে কাতারে কাতারে মানুষ হত্যা করে। পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, লেখক, সংবাদকর্মী, সমাজকর্মী, ব্যবসায়ী, অভিনেতা, ক্রীড়াবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিত মানুষদের। একাত্তর সালের ৯ মাসে ৩৬৯ বর্গমাইল আয়তনের মুন্সীগঞ্জের ৪২টি স্থানে ১৪৫টি গণহত্যা সংঘটিত হয়।
স্বাধীনতার এতো ৪৮ বছর পার হলেও জেলায় জানা অজানা বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি এখনও রয়েছে অরক্ষিত। আর যেসব বধ্যভুমি চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ ও নামফলক স্থাপন করা হলেও অনেক শহীদদের নাম আজও রয়েছে অজানা।