মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের নতুন ভবনটি গত ৫ বছরেও চালু হয়নি

শেখ মোহাম্মদ রতন, সমকালীন মুন্সীগঞ্জ :

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নতুন ভবনটি নির্মানের ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও চিকিৎসা সেবার জন্য চালু হয়নি। বর্তমানে এ হাসপাতালটি ১শ’ শয্যার হলেও তা এখনো চলছে ৫০ শয্যার লোকবল দিয়ে।

এদিকে পুরাতন ভবনে বেডের কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। বাধ্য হয়ে অনেকেই মেঝেতে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। কবে নাগাদ নতুন হাসপাতালটি চালু করা হবে, স্পষ্টভাবে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন হাসপাতালে বিছানা না পেয়ে অনেকে মেঝেতে বিছানা করে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। তাদের একজন রহিমা খাতুন জানান, ‘আজ তিনদিন হলো মেয়ের চিকিৎসা নিতে এসেছি। সিট না পেয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মেঝেতেই বিছানা করে থাকতে গিয়ে আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে গেছি অন্যদিকে মুন্নী নামের একজনের সাথে কথা হয়।

তিনি বলেন, ‘আমার মা বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সিট না পেয়ে নিচে বিছানা করাতে আমার মা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে গেছে। এখান থেকে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার কথা ভাবছি।

এদিকে পুরাতন হাসপাতাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জ শহরের মানিকপুর এলাকায় মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের পুরাতন ভবন ঘেঁষে নতুন হাসপাতালের পাঁচ তলা ভবনটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভবনটির চার পাশ দেয়াল ঘেরা। প্রতিটি তলার কক্ষের দরজা-জানালার কাজ শেষ হয়েছে। তবে কোন কক্ষে বাতি ও পাখা লাগানো হয়নি।

লিফটের জায়গাও ফাঁকা। প্রতিটি তলা ও কক্ষে ধুলাবালির আস্তরন জমে আছে। ভবনটির দ্বিতীয় তলায় থাকেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দুইজন তত্বাবধায়ক। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স নুরানী এন্টার প্রাইজ সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ২ কোটি ৭৭ লক্ষ ৮৬ হাজার ৩শ’ ৩৩ টাকা ব্যয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে নতুন ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্বাবধায়ক জানান, এখনও ভবনে পানি, গ্যাস, ইলেকট্রিক ও লিফটের কাজ করা হয়নি। এগুলো আমাদের কাজ নয়। আড়াই বছর আগে কাজ শেষ হলেও গণপূর্ত অধিদফতর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে হাসপাতালটি বুঝে নেননি।

স্থানীয় লোকজন বলেন, গত এক বছর ধরেই শুনছি নতুন হাসপাতাল সামনের মাসে চালু করা হবে। তাদের দাবি অবিলম্বে নতুন হাসপাতালটির পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালু করতে হবে। কবে এই নতুন হাসপাতাল থেকে মানুষ চিকিৎসা সেবা পাবে তা কেউ জানে না।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও সু-স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। এদিকে প্রায় ১৫ লাখ জন সংখ্যার এই জেলার ১শ’ শয্যার মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালটি রোগীদের ঠিক মত সেবা দিতে পারছে না। ২০০৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালটিকে ৫০ শয্যা থেকে ১শ’ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এ হাসপাতালটি ১শ’ শয্যার হলেও তা এখনো চলছে ৫০ শয্যার লোকবল দিয়ে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন এখানে গড়ে আট থেকে নয়শ’ জন রোগী সেবা নিতে আসেন। মাত্র ২০-২২ জন ডাক্তার দিয়ে চালানো হচ্ছে হাসপাতালটি। দিন যত যাচ্ছে রোগীর চাপও এখানে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বলে জানান তারা। ভর্তি রোগীদের শয্যার চেয়ে হাসপাতালের বারান্দা ও কক্ষের মেঝেতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেশি থাকতে দেখা গেছে।

চিকিৎসক দেখিয়েছেন এমন কয়েক জনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২-৩ ঘন্টা লাইনে থেকে চিকিৎসকের কক্ষে ঢুকতে পারলেও ভালো চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এক মিনিটে এক সাথে দেখা হচ্ছে চার-পাঁচজন রোগী।

এরপর দায়সারা ভাবে দেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থাপত্র। হাসপাতাল থেকে তেমন কোন ঔষধও দেওয়া হচ্ছে না। সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়।হাসপাতালে পর্যাপ্ত সিলিং ফ্যান নেই। যেগুলো আছে সেগুলোও ঠিকমত চলছে না। হাসপাতালের শৌচাগার সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপোযোগি। ভিতরে পানির ব্যবস্থা নেই।

রোগীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের ময়লা স্তুপ আকারে জমা হয়ে আছে। হাসপাতালের তিনটি এ্যাম্বুলেন্সের একটি দীর্ঘদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। দুটি সচল থাকলেও কিছু দিন পরপর মেরামত করতে হচ্ছে।

ফাতেমা বেগম নামে একজন বলেন, ‘আমার মেয়েকে অসুস্থ্য অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ভর্তি থাকতে বলে। হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় মহিলা ওয়ার্ডে অনেক রোগী। আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে আগে যেখানে কয়েকটা বেড ছিল এখন তাও নেই। ভিতরের পরিবেশটাও খুব খারাপ। তাই বাধ্য হয়ে বারান্দার মেঝেতে থাকতে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, অনেকে ভর্তি হওয়া সত্বেও জায়গা না থাকায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতাল ভবন মেরামত না করায় এটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের এমন দূরাবস্থায় আমাদের মত রোগীদের কথা চিন্তা করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন ভবনটি চালু করা উচিৎ।

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার-(আরএমও) ডা. এস এম মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নতুন হাসপাতাল কবে চালু হবে, কি ভাবে হবে আমার এ ব্যাপারে কিছু জানা নেই। আমাদের (পুরোনো) হাসপাতালটি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল ছাড়া কোন রকমে চলছে। নতুন ভবন চালু করতে হলে, নতুন জনবল নিয়োগ দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে হলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনতে হবে। তাই যে সব যন্ত্রপাতি দরকার সেগুলো নিয়ে ও জনবল নিয়োগ দেওয়ার পরই নতুন ভবন চালু করা উচিৎ হবে।

গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মশিউর রহমান বলেন, আমি মাত্র কয়েক মাস হয় মুন্সীগঞ্জে যোগদান করেছি। এ ব্যাপারে আমার তেমন কিছু জানা নেই। তবে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কিছু কাজ বাকি রয়েছে।

এ ছাড়াও লিফট ও ইলেকট্রিকাল কাজ, পানির সংযোগও এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। তাই আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ বুঝে নিতে পারছিনা।

তিনি আরও বলেন, এই কাজটা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রজেক্টের আওতায়। জাইকার অর্থায়নে ভবনের কাজ করা হচ্ছিল। এখন ফান্ডে টাকা না থাকায় কাজগুলো সম্পূর্ণ করা যাচ্ছেনা। তবে আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই কাজ সমাপ্ত করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা যাবে।

সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পুরাতন হাসপাতালে মানুষের দুর্ভোগের কথা শুনেছি। নতুন ভবনটির কাজ আরো আগে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ কেন এখনো শেষ করা যায়নি এ ব্যাপারটি নিয়ে খুব শীঘ্রই গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সাথে বসবো। ভবনের কাজ শেষ না হলে জনবল নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি কোনটার ব্যবস্থাই করা যাবে না।’

তবে নতুন হাসপাতালটি কবে থেকে চিকিৎসা সেবা দিতে পারবে এ বিষয়টি জানতে চাইলে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি ডা. মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান।