মুন্সীগঞ্জের সাহসী কনস্টেবল খ্যাত পারভেজ মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে এখন হাসপাতালে। এ পর্যন্ত প্রায় ১১ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতির দিকে।
২০১৭ সালের ৭ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সাহসী সেই কনস্টেবল পারভেজ মিয়া নিজেই সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে এখন হাসপাতালে। তাকে বাঁচাতে আশা করা হচ্ছে তাকে আর রক্ত দেওয়া লাগবে না।
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) সকালে কনস্টেবল পারভেজ মিয়ার ছোট ভাই মহিউদ্দিন বলেন, ‘আজকে ভাইয়ের অনেক ভালো লাগছে। গত মঙ্গলবার (২৮মে) সে বলেছিল ভালো লাগছে না। প্রথম অবস্থায় ভাইকে দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। পরে আরো আট ব্যাগ মোট ১০ ব্যাগ (ও পজিটিভ) রক্ত দেওয়া হয়েছে। তবে আশা করা যাচ্ছে আর রক্ত লাগবে না। পুলিশের আইজিপি ও ডিআইজি সব সময় কনস্টেবল পারভেজ মিয়ার খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।’
মহিউদ্দিন বলেন, ‘এক থেকে দেড় মাস ভাইকে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে বলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা জানিয়েছেন। শুনেছি তাকে সিঙ্গাপুর নিয়ে চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে সিঙ্গাপুরেও চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
কনস্টেবল পারভেজ মিয়া মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার হোসেন্দি ইউনিয়ন এর হোসেন্দি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাসেমের ছেলে।
পুলিশ সুত্রে জানা গেছে, কৃত্রিম পা সংযোজন এর মাধ্যমে আবার কর্মস্থলে ফিরতে চান পারভেজ। সরকার ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে কৃত্রিম পা সংযোজন এর ব্যাপারে কথা বলা হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে আশ্বাসও দিয়েছেন।
গজারিয়ার হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. কবির হোসেন জানান, গজারিয়া উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জামালদি বাসস্ট্যান্ডের সামনে গত সোমবার (২৭ মে) বিকেলে কনস্টেবল পারভেজকে ধাক্কা দেয় একটি বেপরোয়া কাভার্ড ভ্যান। এতে তার ডান পায়ের গোড়ালি ও হাত মারাত্মক জখম হয়। মঙ্গলবার (২৮ মে) বিকেলে জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকরা অপারেশন করে তার ডান পা কেটে বাদ দিয়েছেন।
সিসিটিভি ফুটেজ এর মাধ্যমে গাড়ির নম্বর ও কোন কোম্পানির গাড়ি তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। গাড়িটি ন্যাশনাল ক্যারিয়ার কোম্পানির কাভার্ড ভ্যান ছিল। গাড়িটি আটকের চেষ্টা করছে পুলিশ। প্রয়োজনে সিআইডিকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে গজারিয়ার হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. কবির হোসেন জানান।
তিনি আরো জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হবার পর প্রথমে তাকে গজারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকার রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠায়। ঢামেক হাসপাতাল থেকে তাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) পাঠানো হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই ভর্তি আছেন। মঙ্গলবার বিকেলে তার পায়ের অস্ত্রোপচার করা হয়।
কাভার্ডভ্যানের চাপায় পা হারানো পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ মিয়া সুস্থ হয়ে ফেরার পর দুর্ঘটনাস্থলের পুলিশ কন্ট্রোল রুমেই হবে তার কর্মস্থল বলে জানিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা।
পারভেজ মিয়ার বরাত দিয়ে তার ভাই মো. মহিউদ্দিন জানান, শনিবার (১ জুন) পারভেজের পায়ে ড্রেসিং করা হবে। এরপর বোঝা যাবে পা কি অবস্থায় আছে। কোনো সমস্যা হলে তখন আরও দুঃশ্চিন্তা বাড়বে। এখন পর্যন্ত ১১ ব্যাগ রক্ত লেগেছে। কৃত্রিম পা সংযোজন করা হবে। দুর্ঘটনার সাতদিন আগে পারভেজের মা স্ট্রোক করেছিলেন।
তিনি জানান, আমাদের নিজস্ব বাড়িঘর নেই। পারভেজের পেনশনের টাকা দিয়ে বাড়ি তৈরির ইচ্ছা ছিল। বর্তমানে পারভেজ চাকরিতে ফেরা নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু মাস শেষে ভাতা ছাড়া আর নিজেদের নিজস্ব জায়গা নেই।
তিনি আরও জানান, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন পারভেজের চাকরিতে ফেরা নিয়ে। যেখানে তিনি পা হারিয়েছিলেন সেখানেই কন্ট্রোল রুমে চাকরি করবেন।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (৩০ মে) বিকেলে সেই কাভার্ডভ্যানসহ চালক ও হেলপারকে কাঁচপুর সেতু এলাকা থেকে আটক করেছে হাইওয়ে পুলিশ।
আটকৃতরা হলেন- নোয়াখালীর জেলার ছগিরহাট থানার আশ্রাফপুর গ্রামের মো. ইয়াছিল উল্লাহ মামুন (২৪) ও একই গ্রামের আব্দুল মজিদে ছেলে মো. জাহিদুল ইসলাম (২৩)।
ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন জানান, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে কাভার্ডভ্যানটির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার হাইওয়ে পুলিশ কাঁচপুর সেতু এলাকা থেকে কাভার্ডভ্যানসহ চালক ও হেলপারকে আটক করা হয়।
তিনি আরও জানান, ওইদিন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাভার্ডভ্যানটি হেলপার চালাচ্ছিল। কাভার্ডভ্যানটির মূল চালক জাহিদুল ইসলাম হলেও সেদিন গাড়িটি চালচ্ছিলেন ইয়াছিল উল্লাহ মামুন। প্রাথমিকভাবে আটককৃত চালক ও হেলপার পারভেজকে ধাক্কা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ৭ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চাঁদপুরগামী যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডোবায় পড়ে যায়। যাত্রীদের রক্ষায় জীবন বাজি রেখে ডোবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন তৎকালীন দাউদকান্দি হাইওয়ে থানায় কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ মিয়া। ইউনিফর্ম পড়েই পানিতে নেমে ২০ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেন তিনি। পারভেজ মিয়ার ওই সাহসিকতার জন্য তাকে দেওয়া হয় পুলিশের সর্বোচ্চ পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম)।