মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পালকি বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন

শেখ মোহাম্মদ রতন, সমকালীন মুন্সীগঞ্জ  :

মানুষ বহনের একটি প্রাচীন বাহন পালকি।

এই বাহনে একজন বা দুজন যাত্রী নিয়ে দুজন থেকে আটজন বাহক কাঁধে তুলে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যেত।

‘পালকি’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পল্যঙ্ক’ বা ‘পর্যঙ্ক’ থেকে উদ্ভূত।

পালি ভাষায় এই যানের নাম ‘পালাঙ্কো’।

হিন্দি ও বাংলায় এটি পালকি নামে পরিচিত।

বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও চতুর্দশ শতকের পর্যটক জন ম্যাগনোলি ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।

সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল এবং পরবর্তী সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল পালকি।

আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা পালকিতে চড়েই যাতায়াত করতেন।

জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিয়েতে ও অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে বর-কনের জন্য পালকি ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল।

জেলার সিরাজদিখানের ৭০ বছরের বৃদ্ধা আম্বিয়া বেগম জানান, ২০ বছর বয়সে পালকিতে চড়ে বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে এসেছি।

বয়স হয়ে গেছে, তবে আজও মনে পড়ে সেই দিনের কথা।

গ্রামে বিয়ে হলেই বর-কনেকে পালকিতে করে গান গাইতে গাইতে নিয়ে আসা দেখতে খুব আনন্দ পেতাম।

এখন আর পালকি দেখা যায় না।

টঙ্গীবাড়ী উপজেলার পূরা বাজারে থাকা পালকিচালক গমরেস বলেন, আমাদের বাবা-দাদারা প্রাচীনকাল থেকে পালকি দিয়ে বিয়ের সময় বর-কনেকে বহন করতেন।

আমরা এককালে কলকাতার লোক ছিলাম। কাজের তাগিদে বংশের ঐতিহ্য রক্ষায় আমরাও পালকি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য বাংলাদেশে চলে আসি।

এখন আর আগের মতো বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাদের ডাকা হয় না।

অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতে হয় আমাদের।

মাসে দু-একটা বিয়েতে আমাদের ডাক পড়ে।

যা পাই তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে।

বিভিন্ন আকৃতি ও ডিজাইনের হয়ে থাকে পালকি।

সবচেয়ে ছোট ও সাধারণ পালকি (ডুলি) দুজনে বহন করেন।

সবচেয়ে বড় পালকি বহন করে চার থেকে আটজন।

পালকি বাহকদের বলা হয় বেহারা বা কাহার।

হাডি, মাল, দুলে, বাগদি, বাউডি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ পালকি বহন করে।

পালকি বহনের সময় তারা বিশেষ ছন্দে গান গায়।

তাদের চলার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গানের তাল-লয় পরিবর্তিত হয়।

কাঠমিস্ত্রিরা সেগুন ও শিমুলের কাঠ দিয়ে পালকি তৈরি করে। বটগাছের বড় ঝুরি দিয়ে তৈরি হয় পালকির বাঁট বা বহন করার দণ্ড।

পালকি সচরাচর তিন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন সাধারণ পালকি, আয়না পালকি ও ময়ূরপঙ্খি পালকি।

সাধারণ পালকি আয়তাকার।

চারদিক কাঠ দিয়ে আবৃত ও ছাদ ঢালু।

এর দুদিকে দুটি দরজা থাকে।

কোনো কোনোটিতে জানালাও থাকে। পালকির বাইরের দিকে আলপনা আঁকা থাকে।

ভেতরে চেয়ারের মতো দুটি আসন ও একটি টেবিল থাকে।

ময়ূরপঙ্খি পালকির আয়তন সবচেয়ে বড়।

এই পালকি ময়ূরের আকৃতিতে তৈরি করা হয়।

ভেতরে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল ও তাক থাকে। এ পালকির বাঁটটি বাঁকানো। এর বাইরের দিকে কাঠের তৈরি পাখি, পুতুল ও লতাপাতার নকশা থাকে।

অতীতে পালকি ছিল এ যুগের মোটরগাড়ির অনুরূপ।

স্টিমার ও রেলগাড়ি আবির্ভাবের আগে ভারতের গভর্নর জেনারেলও পালকিতে চড়ে যাতায়াত করতেন।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে ডাক ও যাত্রী বহনের জন্য ডাকবিভাগ ‘স্টেজ পালকি’ চালু করে। এই প্রথা উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

দূরের যাত্রীরা ডাকঘর থেকে স্টেজ পালকির টিকিট কিনত। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে ইংরেজরা পালকিতে চড়া প্রায় বন্ধ করে দেয়।

তবে উনিশ শতকের শেষাবধি স্থানীয় অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তিরা যাতায়াতের জন্য পালকিই ব্যবহার করত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ অবস্থানকালে তার জমিদারি কাচারি পরিদর্শনের সময় যে পালকি ব্যবহার করতেন, তা এখনও কুঠিবাড়িতে সংরক্ষিত রয়েছে।

সে যুগে সচ্ছল পরিবারের নিজস্ব পালকি থাকত ও তাদের ভৃত্যরাই তা বহন করত।

সাধারণ মানুষ পালকি ভাড়া করত।

উনিশ শতকের চতুর্থ দশকে দাসপ্রথা বিলোপের পর ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর ও মধ্যপ্রদেশ থেকে পালকি বাহকরা বাংলায় আসতে থাকে।

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকে পালকি বাহকের কাজ নেয়।

শুষ্ক মৌসুমে তারা নিজেদের এলাকা থেকে এদেশে আসত।

বর্ষা মৌসুমে চলে যেত। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম শেষে তারা কয়েকটি এলাকায় যেত।

কোথাও অস্থায়ী কুঁড়েঘর বানিয়ে সাময়িক আবাসের ব্যবস্থা করে নিত।

উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হওয়ার পর পালকির ব্যবহার কমতে থাকে।

ক্রমেই সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি ও পশুচালিত যান চালু হলে যাতায়াতের বাহন হিসেবে এর ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত প্রসার, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্য যান চলাচল এবং প্যাডেলচালিত রিকশা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।

বর্তমানে পালকি বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।

 

 

শেখ মোহাম্মদ রতন / ০১৮১৮৩৩৬৮০৮ / ৩০ -০৩-১৮ / সমকালীন মুন্সীগঞ্জ