নির্বাচনে হামলা-মামলার আতঙ্কে মুন্সীগঞ্জের সাধারণ ভোটাররা

শেখ মোহাম্মদ রতন, সমকালীন মুন্সীগঞ্জ:-২৪-১২-২০১৮

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে ও ভোটের দিন সন্ত্রাসী হামলার আতঙ্কে রয়েছে জেলার সাধারন জনগন ও ভোটাররা।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে মুন্সীগঞ্জে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে অত্যাধুনিক অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারী ও মজুদ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের কারণে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে মুন্সীগঞ্জ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে প্রকাশ্যেই অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

পৃথক ঘটনায় গত দু’বছরে গুলিতে ১৩ জন নিহত, গুলিবিদ্ধসহ ৭৫ জন আহত হয়েছেন। উদ্ধার হয়েছে ১৯টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গুলি। এর পরও বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র রয়ে গেছে। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার এড়াতে পলাতক রয়েছে।

এসব সন্ত্রাসী একাদশ সংসদ নির্বাচনে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

জেলার একাধীক গোয়েন্দা সংস্থার সুত্রে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সদর থানা পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক-শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবলীগ কর্মী শাহজালাল মিজি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। এ সময় দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়।

২৪ এপ্রিলে সদরের পূর্ব মাকহাটী গ্রামে বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসী মিল্টন মল্লিক ও তার সহযোগীরা প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেয়। ঘটনার দেড় বছরেও মিল্টন মল্লিক গ্রেফতার হয়নি।

২ ও ৩ মে দু’দিনব্যাপী চরাঞ্চলের মোল্লাকান্দিতে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের মধ্যে আবারও দফায় দফায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধসহ ৩০ জন আহত হয়। সংঘর্ষে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একাধিক সন্ত্রাসী গুলিবর্ষণ করে।

১০ জুন চরকেওয়ারের দক্ষিণ চরমশুরা গ্রামে দু’পক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে মাসুদ ঢালী নামের যুবক নিহত ও গুলিবিদ্ধ হয় ১০ জন।

১১ নভেম্বর আধারার কালিরচর গ্রামে অভিযান চালিয়ে ৩ রাউন্ড গুলি, একটি বিদেশি পিস্তলসহ নৌ-ডাকাত রুহুল আমিনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।

১৪ নভেম্বর মোল্লাকান্দির পশ্চিম মাকহাটী গ্রাম থেকে গুলি, বিদেশি পিস্তলসহ শিপন হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আমান মাঝিকে গ্রেফতার করা হয়।

৭ ডিসেম্বর মোল্লাকান্দিতে দু’পক্ষের সংঘর্ষের পর চরডুমুরিয়া গ্রাম থেকে শর্টগানসহ আফজাল নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়।

এদিকে, ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি মোল্লাকান্দিতে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ ৩০ জন আহত হয়। এ সময় চরডুমুরিয়া গ্রাম থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি একনলা বন্দুক উদ্ধার করে পুলিশ।

একই সালের ২ ফেব্রুয়ারি চরাঞ্চলের সরদারকান্দি এলাকায় পুলিশ ও নৌ-ডাকাতদের বন্দুকযুদ্ধে তারেক রহমান রিংকু নামের এক নৌ-ডাকাত নিহত ও এসআই সঞ্জয় কুমার গুলিবিদ্ধসহ পাঁচ পুলিশ আহত হয়।

৪ ফেব্রুয়ারি চরাঞ্চলের মোল্লাকান্দির মহেশপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে জাহাঙ্গীর সরকারকে একটি শটগান ও একটি বিদেশি পিস্তল, গুলিসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব।

১২ ফেব্রুয়ারি রাতে সদরের গজারিয়াকান্দি গ্রামে অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান এবং একটি স্নাইপার রাইফেল, দুটি দেশে তৈরি ওয়ান শুটারগান, ১৪ রাউন্ড গুলি ও আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

২৫ এপ্রিল মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার চরহায়দ্রাবাদ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম আরিফ নিহত ও ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, আটটি গুলি, একটি গুলির খোসা ও চাপাতি উদ্ধার করা হয়।

১১ জুন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের কাকলদী তিন রাস্তা মোড়ে লেখক-প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করে জেএমবির সদস্যরা।

২৭ জুন রাতে সদরের মিরকাদিমের মুরমা এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের দু’গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে সুমন বিশ্বাস নিহত হয়। একই দিন রাত ৩টার দিকে সিরাজদীখানের কালীনগর গ্রামের একটি ভাড়া বাসায় তল্লাশি চালিয়ে একটি পিস্তল, ২১ রাউন্ড গুলি ও চারটি তাজা হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার করে ফেরার পথে জঙ্গিদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জেএমবি নেতা আবদুর রহমান নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয় একটি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও ৯ রাউন্ড গুলি।

১০ আগস্ট লৌহজংয়ের কুমারভোগ এলাকায় র‌্যাব-মাদক সিন্ডিকেটের বন্দুকযুদ্ধে মুকবুল হোসেন নিহত ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া শহরের দক্ষিণ ইসলামপুরের অপর মাদক ব্যবসায়ী মালেক র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।

৬ নভেম্বর রাতে জেলার শ্রীনগর উপজেলার কেসি রোড এলাকায় সাংবাদিক প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বোমা শামীম ও এখলাসুর নামে জেএমবির দুই জঙ্গি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। ১৬ অক্টোবর সদরের চরাঞ্চলের জাজিরা কুঞ্জনগর গ্রামের বিএনপি কর্মী শাহজালালের বাড়ি থেকে ২২ পিস কার্তুজের গুলি উদ্ধার করে পুলিশ।

সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর সদরের সিপাহীপাড়া বল্লালবাড়ী এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ী ও শির্ষ সন্ত্রাসী ল্যাংড়া খসরু ও কানা সুমন নিহত হয়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে তিনটি পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়।

এ প্রসঙ্গে, মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. জাহেদুল আলম পিপিএম বলেন, বিগত সময় থেকে শুরু করে বর্তমানে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাদক ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার কাজ অব্যাহত আছে। নির্বাচনে সকল প্রকার অপ্রিতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলার পুলিশ-প্রশাসন সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা যে দলেরই হোক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।