দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বেমানান

সমকালীন মুন্সীগঞ্জ ডেক্স :

পত্রিকায় নানা ধরনের খবর প্রকাশিত হয়। তথ্যসমৃদ্ধ খবর। তথ্যসমৃদ্ধ মেদবহুল খবর। তথ্যসমৃদ্ধ মেদহীন খবর। অপ্রয়োজনীয় তেলবাজ খবর।

গল্পসমৃদ্ধ খবর। আর মিথ্যা বা ভুয়া খবর। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজন তথ্যসমৃদ্ধ মেদহীন সঠিক খবর।

বাকিগুলো দিয়ে পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়ানো গেলেও জনপ্রিয়তা বাড়ানো যায় না।

মিথ্যা খবর যখন ছাপা হয়, ইংরেজিতে তাকে লাইবেল বলা হয়। লাইবেলের সঙ্গে মানহানির বিষয়টি খুবই মানানসই।

আর এ নিয়ে উন্নত বিশ্বের গণমাধ্যম দীর্ঘদিন বড় ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে।

খ্যাতিমান কারও বিরুদ্ধে রিপোর্ট হলেই সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন ডলারের মামলা রুজু।

আর এ নিয়ে দৌড়ের ওপর থাকে উন্নত বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো।

আর এ সমস্যার সমাধানে ২০১৩ সালে ব্রিটেনে ডিফ্যামেশন আইন সংশোধন করা হয়।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতাকে উৎসাহ দিতে এই আইন করা হয়।

২০১৪ সালের প্রথম থেকেই আইনটি কার্যকর করা হয়।

নতুন আইনটি কার্যকর করার পর মিডিয়ার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা কমে গেছে অস্বাভাবিক হারে।

কারণ নতুন আইনে মিডিয়ার স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জনস্বার্থে গণমাধ্যম যেকোনো ধরনের খবর প্রকাশ করতে পারবে।

একটি খবরের কারণে যদি কোনো পক্ষের ইমেজ ক্ষুন্ন হয় এবং ওই খবরটি জনগণের জানা জরুরি হয়, তাহলে মানহানির মামলা করা যাবে না।

কোনো খবরে জনস্বার্থের বিষয় নেই। কিন্তু তাতে কোনো পক্ষের ইমেজ ক্ষুণœ হলে তাকে আগে প্রমাণ করতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট খবরের কারণে তিনি সামাজিকভাবে ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তারপরেই মামলা নেওয়া হয়।

মানহানির মামলার জন্য লন্ডন বিশ্বে খুবই জনপ্রিয় এক শহর। শহরটি লাইবেল ক্যাপিটাল নামেও পরিচিত।

এর অন্যতম কারণ হলো সারা বিশ্বেও সেলিব্রিটিরা মানহানির মামলার জন্য লন্ডনকেই বেছে নেন।

ফোর্বস, নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিশ্বের বড় বড় মিডিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করতে সেলিব্রিটিরা লন্ডনকে বেছে নেন, কারণ এসব মামলায় ন্যায়বিচারের পাশাপাশি বড় ক্ষতিপূরণের জন্য লন্ডন সবার আগে।

লন্ডন লাইবেল ক্যাপিটাল হলেও সেখানে কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের তেমন কোনো মামলা থাকে না।

কোনো মন্ত্রীকে মিডিয়া ধুয়ে দিলেও সরকার তা গায়ে মাখে না, বরং এসব সমালোচনা সরকারের জবাবদিহিতাকে নিশ্চিত করে বলে সরকার মিডিয়াকে উৎসাহ প্রদান করে।

সে দেশের জনগণ ও সরকার মনে করে দেশের মিডিয়া যত শক্তিশালী ভূমিকা নিতে পারবে, জনগণের স্বার্থ ততই বেশি সুরক্ষিত থাকবে, গণতন্ত্র তত বেশি বিকশিত হবে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের বিচারব্যবস্থার অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে।

তবে সে  দেশের আদালত মিডিয়াকে ভুয়া খবরের জন্য বড় ধরনের জরিমানা করে থাকে।

এ নিয়ে খুবই আলোচিত মামলা রেনল্ড ভার্সাস টাইমস নিউজপেপার।

টাইমস ম্যাগাজিন ১৯৯৯ সালে আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলবার্ট রেনল্ডের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি সংসদকে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন এবং তিনি মিথ্যা বলেছেন।

মজার বিষয় হলো, ওই প্রতিবেদনে রেনল্ডের বক্তব্য নেওয়া হয়েছিল। আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত সংখ্যায় তা ছাপা হয়েছিল।

কিন্তু ইউকে সংস্করণে তার বক্তব্য বাদ দেওয়া হয়।

এ কারণেই মামলায় রেনল্ডের জয় হয়, হেরে যায় টাইমস ম্যাগাজিন।

লন্ডন হাইকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকরা ওই মামলায় দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার জন্য ১০টি পয়েন্ট তুলে ধরেন।

পরবর্তী সময়ে এটিই ‘রেনল্ড ডিফেন্স’ নামে পরিচিতি পায়।

উন্নত বিশ্বে গণমাধ্যম সরকারি ও বিরোধী দলের বন্ধু।

আর অনুন্নত দেশে গণমাধ্যম সবসময় বিরোধী দলের বন্ধু আর সরকারের জন্য একটি বিব্রতকর মাধ্যম।

এ কারণে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আবার বিরোধী দলে গেলে তার জন্য আক্ষেপ করে।

তার পরও সরকার গণমাধ্যমের বন্ধু হতে পারে না।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্য।

সরকার বিরোধী দল নয়, গণমাধ্যমকেই প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করে।

এ কারণে মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সরকার তা গায়ে মাখে।

পাশাপাশি এর জন্য মন্ত্রী বা এমপিকে না দুষে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমকে নজরদারি শুরু করে।

আমাদের গণমাধ্যম সবসময় যে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তা কিন্তু নয়।

এখানে সাংবাদিকরা মূলত দু’ভাগে বিভক্ত।

সরকারি ফোরামের সাংবাদিক, বিরোধী ফোরামের সাংবাদিক।

এর বাইরে যারা নিরপেক্ষভাবে সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেন, তাদের বেশিরভাগ বেকার।

কোনো পক্ষই তাদের পছন্দ করেন না।

অনেকেই তাদের বিভিন্ন নামে সম্বোধন করেন।

সব মিলে আমাদের সাংবাদিকতা ভালো অবস্থায় নেই।

নীতি-নৈতিকতার চেয়ে এখন দলবাজি বড় হয়ে গেছে।

এছাড়া সাংবাদিকরা এখন অনেক বেশি বৈষয়িক, যার কারণে সত্যিকারের পেশাদারিত্ব কম দেখা যাচ্ছে।

আর এ কারণে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য খুব সহজ হয়ে উঠেছে।

সরকারের কর্মকাণ্ডের অনেক সমালোচনা থাকলেও গত ৯ বছরে রয়েছে অনেক সফলতা।

তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল পাচ্ছে।

ঘরে বসে মোবাইল ফোনে পরীক্ষার রেজাল্ট দেখতে পাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা।

এক মিনিটের মধ্যে বাবা তার সন্তানের কাছে টাকা পাঠাতে পারছেন।

স্মার্টফোনে মা প্রবাসী সন্তানের সঙ্গে ভিডিও কল দিয়ে কথা বলছে।

এটি ১০ বছর আগে চিন্তারও বাইরে ছিল। মানুষ এখন তা উপভোগ করছে।

দেশের গণমাধ্যমে চলছে নতুন আতঙ্ক। আর তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে।

প্রস্তাবিত এ আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে।

এ আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় বিধান রাখা হয়েছে।

এ আইনটি পাস হলে অনেক রিপোর্টারই বিপদে পড়বেন। বিশেষ করে চোথা-নির্ভর রিপোর্টাররা বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন।

৫৭ ধারার স্থলে ৩২ ধারা নতুন বিপদ নিয়ে এসেছে।

৩২ ধারা নিয়ে অবশ্য আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন।

তারপরও বিতর্কের শেষ নেই।

সেদিন সরকারি ফোরামের এক সাংবাদিক আইনটির সমালোচনা করে বলেছেন, এটি সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা একটি অতি উৎসাহী পক্ষের কাজ।

শেষ সময়ে সরকার ডিজিটাল ব্যবস্থা আর ৩২ সংখ্যাটিকে বিতর্কিত করেছে।

৩২ নম্বরের সঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের আবেগ জড়িতÑসাংবাদিক দমনে কেন এ ধারা ব্যবহার করা হবে? তিনি বলেন, আর কোনো ধারা ছিল না যে ৩২ ধারারই প্রয়োজন হলো।

আইনের নাম ডিজিটাল নিরাপত্তা না দিয়ে অন্য কোনো নিরাপত্তাও দেওয়া যেত।

তাকে প্রশ্ন করলাম, ধারা যা-ই হোক, বিষয়বস্তু এক হলে তো সাংবাদিকদের সমস্যা থেকেই যাবে। তিনি এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

দেশের জন্য আইন।

মানুষের জন্য আইন।

প্রস্তাবিত আইনটি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পরিপন্থি।

এ আইন চূড়ান্ত হলে জনস্বার্থের অনেক খবরই প্রকাশ করতে পারবে না গণমাধ্যম।

সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আতঙ্কের মধ্যে থাকবেন।

এটা গণমাধ্যমের জন্য মোটেও সুখকর হবে না।

এতে বাধাগ্রস্ত হবে গণতান্ত্রিক বিকাশ। তাই বিষয়টিকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এখন।

ডিজিটাল আইনকে যুগোপযোগী করতে উন্নত বিশ্বকে অনুসরণ করাই সঠিক হবে।

বাংলাদেশের অনেক আইন ব্রিটিশ আমলের। তারাই মূলত আইনের খুঁটিনাটি বিষয় শিখিয়ে দিয়েছে।

তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে ব্রিটেনের ‘ডিফ্যামেশন অ্যাক্ট ২০১৩’ দেখে নিয়ে সে অনুযায়ী অগ্রসর হলে সরকারের শেষ সময়ের অহেতুক বিতর্ক এড়ানো যাবে।

পাশাপাশি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার মাধ্যমে এ পেশার উন্নয়ন হবে বলে আশা করছি। খবর সুত্র-শেয়ার বিজ ।

সাংবাদিক,

এম এম জামান:-

 

শেখ মোহাম্মদ রতন / সমকালীন মুন্সীগঞ্জ / ০১৮১৮৩৩৬৮০৮ / ২৩.০২.১৮