ডিজিটাল সুরক্ষা আইন কাকে দেবে সুরক্ষা ?

সমকালীন মুন্সীগঞ্জ :

বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় গত কয়েক দিন ধরে গুরুত্ব পাচ্ছে মন্ত্রিসভায় সদ্য অনুমোদনপ্রাপ্ত ডিজিটাল সুরক্ষা আইন, ১৮।

এ আইনটি তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলে স্বস্তি পাওয়ার বদলে ভয়ের সঞ্চার করছে।

কেননা, ৫৭ ধারা শেষ হলো কিন্তু ৫৭ ধারার পরিপূরক হিসেবে আরও চারটি ধারা ডিজিটাল আইন, ২০১৮তে সংযুক্ত করা হয়েছে।

এ অর্থে বলা যায়Ñ৫৭ ধারার বদলে বরং আইনটিকে অন্যভাবে আরও কঠোর করা হলো।

সরকার মূলত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুরক্ষার জন্যই এ আইন করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

এর আগেও সরকার সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৫ প্রণয়ন করেছে।

আর ডিজিটাল আইনের কিছু ধারার মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেবল সুরক্ষাকেই মজবুত করা হলো না, বরং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বাইরে থাকার সুযোগ করে দিল। এতে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এ আইন বাস্তবায়নের ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলে আর কিছু থাকবে কি না?

যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য এ আইন হুমকি নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেনÑপ্রকাশিত সংবাদটি যদি সত্য হয়, তবে কোনো সমস্যা নেই। তার মানে মিথ্যা হলে এ আইন বাস্তবায়িত হবে? আর সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের আগেই ৩২ নং ধারা মোতাবেক সেই সাংবাদিককে পুলিশ গ্রেফতার করে বিভিন্নভাবে আদালতে স্বীকারোক্তি নিয়ে নেবে।

ক’দিন পর আইনমন্ত্রী বলেছেন, অকারণে হয়রানির শিকার হওয়া সাংবাদিকের পক্ষে বিনা খরচে মামলায় লড়বেন। কিন্তু কোনটি কারণ আর কোনটি অকারণÑসেটি কে কীভাবে যাচাই করবেন, তা স্পষ্ট করেননি তিনি। খবর শেয়ার বিজের |

এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা মর্যাদাশীল। অথচ তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে লেখা হয়, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। কখনও সংসদ সদস্যদের প্রতিপক্ষ, কখনও দলেরই বিরোধী গোষ্ঠীর কেউ সাংবাদিকদের নানা তথ্য দিয়ে থাকেন।’

এটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে বলা যায়Ñডেইলি অবজারভারের বিরুদ্ধে এর আগে নারায়ণগঞ্জের জনৈক সংসদ সদস্য যে বিষোদ্গার করেছিলেন, এ আইন জারিতে তার বক্তব্য কি অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে?

বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে বর্তমান সংসদ সদস্যদের যে চরিত্র ও প্রকৃতি ফুটে উঠেছে, তা সত্যি হলে আওয়ামী লীগের জন্য অবশ্যই কলঙ্কজনক হবে। কেননা, তখন প্রশ্ন জাগবেÑদলটি কি কেবল স্বচ্ছ ও চরিত্রবান রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে দুর্নীতিবাজদের মনোনয়ন দেয়? অথবা মনোনয়ন দেওয়ার মতো আওয়ামী লীগে ওই ধরনের চরিত্রবান ও সৎ ব্যক্তি নেই? তা না হলে বাণিজ্যমন্ত্রী ডিজিটাল আইনের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে সংসদ সদস্যদের দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গাইবেন কেন?

ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এটা সত্য, তবে সে আইন যদি জনগণকে নিগ্রহমূলক হয় এবং মন্ত্রী-এমপিকে দুর্নীতি করতে উৎসাহ কিংবা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতিবাজ হতে সহায়তা করে, তবে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়।

দিনবদলের সনদ ঘোষণা দেওয়ার পর বাংলাদেশের জনগণ আশা করছিল সব জায়গায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আরও জোরদার হবে; কিন্তু সরকারের নিত্যনতুন এ ধরনের আইন সেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পথকে রুদ্ধ করে দেবে এবং নিরীহ জনসাধারণ  কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা জিম্মি ও নিপীড়নের শিকার হতে পারেন।

ডিজিটাল আইনে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত হলো ৩২ নং ধারা। এতে বলা হয়েছেÑ‘কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে যদি সরকারি, আধাসরকারি স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ষন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সে কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ এবং এ অপরাধের শাস্তি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড কিংবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড।

এ ধারা নিয়ে সাংবাদিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবার শঙ্কা রয়েছে।

কেননা, এ ধারা প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাকস্বাধীনতা হরণ ও সাংবাদিকদের জায়গা অনেকটা সংকুচিত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

৩২ নং ধারায় যা বলা হয়েছে, তার সবটা দিয়ে সাংবাদিকরা তাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পরিচালনা করেন। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া এই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনগণকে বেশ কিছু বিষয়ে সচেতন ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে ভয়ের সঞ্চার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।

কিন্তু এ ডিজিটাল আইনের ৩২ নং ধারা বাস্তবায়িত হলে সাংবাদিকদের এ প্রবণতা কিংবা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। সুতরাং তখন সাংবাদিকরা প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাড়া অন্য কিছু ছাপাতে শঙ্কাবোধ করবেন।

ফলে সাংবাদিকতা পেশাটির অপমৃত্যু হতে পারে! যদিও বিভিন্ন মন্ত্রী বলে বেড়াচ্ছেন, এ আইন ও ধারা নিয়ে সাংবাদিকদের কিংবা মত প্রকাশকারীদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যে ৫৭ ধারা নিয়ে এত সমালোচনার সৃষ্টি হলো, সেই ৫৭ ধারা যখন প্রবর্তিত হচ্ছিল, তখনও বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এ নিয়ে বলেছিলেন ৫৭ ধারা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কিছু নেই। কিন্তু এর বিভিন্ন অপপ্রয়োগের পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিল যে, এটি একটি ‘কালো আইন’।

এই আইনের অপপ্রয়োগের ফলে ৭৪১টি মামলা হয়, যার অধিকাংশই ছিল হয়রানিমূলক। সুতরাং ৫৭ ধারা থেকে আরও শক্তিশালী ৩২ নং ধারার যে অপপ্রয়োগ হবে নাÑতার গ্যারান্টি কী?

মিডিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ ধরে বর্তমানে সিটিজেন সাংবাদিকতার প্রবর্তন হয়; ফলে অধিকাংশ সংস্থায় সেবাগ্রহীতাকে হয়রানির চিত্র ৩২ ধারায় উল্লিখিত ডিভাইসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। কিন্তু ডিজিটাল সুরক্ষা আইন-১৮’র ৩২ নং ধারা প্রবর্তনের ফলে এ ধরনের সিটিজেন সাংবাদিকতা সাংবাদিকরা করতে পারবেন না।

স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনগণের অধিকার ও ত্বরিত সেবা নিশ্চিতে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের ঘোষণা দেয়; কিন্তু এ আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সরকার পক্ষান্তরে তার প্রণীত ডিজিটাইজেশনের বুকে পেরেক ঢোকাল! এ আইন বাস্তবায়ন হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যকারিতা অনেকটা কমে যাবে। কেননা, তারা সরকারি কোনো কর্মকর্তার দুর্নীতি প্রমাণে তেমন কিছু উপস্থাপন করতে পারবে না।

এ আইন বাস্তবায়ন হলে আইনজীবীরা কিছুটা হলেও বিপাকে পড়বেন। কেননা তারা তাদের মক্কেলকে বাঁচাতে এখন কোনো আইনে উল্লিখিত কোনো ডিভাইস ব্যবহার করে মামলার বাদী কিংবা বিবাদীর তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করতে পারবেন না!

এ আইনের ফলে সংবিধানে স্বীকৃত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হবে। অন্যদিকে সাক্ষী সুরক্ষা আইন ও তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। এছাড়া সম্প্রচার নীতিমালা এ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা নিয়ে কারও কোনও উদ্বেগ বা আপত্তি থাকলে সে বিষয়গুলো চিহ্নিত করে তা লিখিত আকারে তথ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার জন্য টিভি চ্যানেল মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেছেন, এখনও সময় আছে, আইনের বিভিন্ন বিষয় সংশোধন করার। সে ক্ষেত্রে লিখিত পেলে সংশোধন আকারে আইনটি পাস করার চেষ্টা করা হবে।

তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে আমরা আশাবাদী। বিভিন্ন প্রয়োজনে সরকার আইন প্রণয়ন করবেÑএটাই স্বাভাবিক। তবে সে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য হবে অবশ্যই জনগণের সেবা, অনৈতিকতার পথ রুদ্ধ করা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে।

কিন্তু এর পরিবর্তে সাধারণ মানুষকে নিগ্রহ করা কিংবা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে এমন আইন প্রণয়ন অবশ্যই নিন্দনীয়।

ডিজিটাল আইনের যেসব ধারা অস্পষ্ট, তা স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা দিয়ে, অংশীজনদের সঙ্গে মত বিনিময় করে প্রয়োজনে গণশুনানির মাধ্যমে মতামত নিয়ে সংসদে পাস করলে জনগণ, সর্বোপরি দেশ উপকৃত হবে।