জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে

সমকালীন মুন্সীগঞ্জ, আন্তর্জাতিক ডেক্স :

বিদেশ থেকে জিয়া অরফানেজ (এতিমখানা) ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

রায়ের পর তাকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে পাঠানো হয়। তবে আগামী রোববার উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।

গতকাল দেশজুড়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করেন।

এ মামলায় ১০ বছর আগে জরুরি অবস্থার মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় বাকি পাঁচ আসামির ১০ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন বিচারক।

বাকি আসামিরা হলেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ।

এদের মধ্যে তারেক মুদ্রা পাচারের এক মামলায় সাত বছরের সাজার রায় মাথায় নিয়ে পলাতক আছেন দেশের বাইরে। কামাল সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমানও পলাতক। আর কারাগারে থাকা সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিনকে রায়ের জন্য গতকাল সকালে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। সাজা ঘোষণার পর আবারও তাদের কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার সাজার এই রায় দেওয়া হয়েছে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায়, ক্ষমতায় থেকে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের’ কারণে। আদালত বলেছে, অভিযোগ প্রমাণিত হলেও ‘বয়স ও সামাজিক মর্যাদা’ বিবেচনায় খালেদা জিয়ার সাজা অন্য আসামিদের তুলনায় কম হয়েছে।

এদিকে জামিনে থাকা খালেদা জিয়া দুপুরে আদালতে পৌঁছানোর পথে বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মী তার গাড়ি ঘিরে মিছিল শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আদালতে পৌঁছানোর পর বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। পুরো রায় ৬৩২ পৃষ্ঠার হলেও এর সংক্ষিপ্তসার ও সাজার অংশটুকু পড়ে শোনানো হয়। রায়ের পরপরই কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে খালেদা জিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কারাগার ভবনে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ রায়ের ফলে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের ‘অযোগ্য’ হলেও হাইকোর্টে আপিল করলে যেহেতু সাজা স্থগিত হয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার ভোটে দাঁড়াতে আইনি বাধা থাকবে না। যদিও দীর্ঘ এ বিচারপ্রক্রিয়ায় মামলা থেকে রেহাই পেতে খালেদা জিয়া উচ্চ আদালতে গেছেন বারবার। তার অনাস্থার কারণে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে তিনবার এ মামলার বিচারক বদল হয়। শুনানিতে হাজির না হওয়ায় তিনবার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেন আদালত।

যদিও বিএনপির অভিযোগ, ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে জরুরি অবস্থার সময় দায়ের করা এ ‘মিথ্যা’ মামলাকে রায় পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তাদের মূল লক্ষ্য রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে খালেদা জিয়াকে ‘সরাতে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার নীলনকশা’ বাস্তবায়ন করা।

রায়ের আগের দিন বুধবার গুলশানে নিজের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেও খালেদা জিয়া ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে নেতাকর্মীদের ‘শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক’ আন্দোলনের নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, ‘দেশবাসীর প্রতি আমার আবেদন, আমাকে আপনাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হলেও বিশ্বাস করবেন, আমি আপনাদের সঙ্গেই আছি। আপনারা গণতন্ত্রের জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, জনগণের সরকার কায়েমের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।’

মামলা-বৃত্তান্ত: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এ মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ।

অভিযোগে বলা হয়, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এ মামলার আসামিরা। মামলা হওয়ার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ বাসুদেব রায় ছয় আসামির বিরুদ্ধে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং দুদক আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করে খালেদা জিয়াসহ ছয় আসামির বিচার শুরু করেন।

এর আগে জরুরি অবস্থার সময় ২০০৭ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর খালেদা জিয়া এক বছর সাত দিন কারাগারে থাকার সময় দুদক এ মামলা করে। পরে এ মামলায় খালেদা ও তারেককে গ্রেফতার দেখানো হয়। এ মামলার বিচার শেষ করতে মোট ২৬১ কার্যদিবস আদালত বসেছে। এর মধ্যে ২৩৬ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে ৩২ জন সাক্ষ্য দেন। আর আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন ২৮ কার্যদিবস। বিচারের শেষ ভাগে দুই পক্ষ মোট ১৬ কার্যদিবস যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করে।

দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা: ‘যে ব্যক্তি তাহার সরকারি কর্মচারীজনিত ক্ষমতার বা একজন ব্যাংকার, বণিক, আড়তদার, দালাল, অ্যাটর্নি বা প্রতিভূ হিসাবে তাহার ব্যবসায় ব্যাপদেশে যে কোনো প্রকারে কোনো সম্পত্তি বা কোনো সম্পত্তির উপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হইয়া সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করেন, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা ১০ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবে।’

দুদক আইনের ৫(২): কোনো সরকারি কর্মচারী অপরাধমূলক অসদাচরণ করিলে বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করিলে তিনি সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের যোগ্য হইবেন। অপরাধমূলক অসদাচরণ সংশ্লিষ্ট অর্থিক সম্পদ অথবা সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হইবে।

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য ও জেরা শেষে খালেদা জিয়া এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে ছয় দিন বক্তব্য দেন। পরে ১৯ ডিসেম্বর জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হলে প্রথম দিন দুদকের পক্ষে মোশাররফ হোসেন কাজল যুক্তি উপস্থাপন করেন।

এরপর ১০ কার্যদিবসে খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মাদ আলী, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুর রেজাক খান, সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন।

উভয় পক্ষের বক্তব্য শেষে বিচারক এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায়ের জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করে দেন।