শেখ মোহাম্মদ রতন :
তৎকালীন বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জে অঞ্চলের মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা হাজার বছর আগের মানবসভ্যতার নিদর্শন নান্দনিক এক বৌদ্ধ নগরীর সন্ধান মিলেছে।
প্রায় পাঁচ বছর ধরে জেলা সদর ও টঙ্গিবাড়ীতে প্রতœতাত্ত্বিক উৎখনন কাজের মধ্য দিয়ে মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হয়েছে শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় উন্নত বৌদ্ধ নগরী।
আবিষ্কারের আদ্যোপান্ত নিয়ে নতুন করে লেখা হতে পারে বিক্রমপুরের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস।
প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণাধর্মী সংগঠন অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে প্রতœ-খনন কাজের মধ্য দিয়ে এই বৌদ্ধ নগরী আবিষ্কৃত হয়েছে। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন নাটেশ্বর গ্রামের বৌদ্ধ নগরী আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।
নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, অনেক বছর আগেও এখানে ছিল স্কুলশিক্ষক নরেশ চন্দ্র দাসের পানবরজ। এখন সেই পানবরজের মাটির নিচে সন্ধান মিলেছে হাজার বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ নগরী।
নরেশ চন্দ্র দাস তার পানবরজসহ এক একর সম্পত্তি দান করেন গবেষণা ও প্রত্ন-উৎখনন কাজের স্বার্থে।
২০১০ সালে জেলা সদরের বজ্রযোগিনী ও রামপালের রঘুরামপুরে প্রত্ন-উৎখননের কাজ শুরু করে। টানা তিন বছর খনন কাজের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালে বজ্রযোগিনী ও রামপালের রঘুরামপুরে মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় বৌদ্ধবিহার।
বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মেছেন গৌতম বুদ্ধ শ্রীজ্ঞান বৌদ্ধ ধর্মের মহাপুরুষ অতীশ দীপংকর। কয়েক বছর আগে বজ্রযোগিনী গ্রামে নিজের বাস্তুভিটায় চীন সরকারের সহযোগিতায় অতীশ দীপংকরের দেহাবশেষ আনা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে অতীশের বাস্তুভিটায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
রঘুরামপুরে বৌদ্ধবিহার আবিষ্কারে শামিল হতে না পারলেও জেলার টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বর গ্রামে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীনের একদল প্রত্নবিদ-গবেষক।
বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্ন-উৎখনন কাজের গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার সমতট ভূমি প্রাচীন বিক্রমপুর।
মুন্সীগঞ্জ ও ফরিদপুরজুড়ে ছিল বিক্রমপুর অঞ্চল।
বর্তমানে মানুষ মুন্সীগঞ্জের ছয়টি উপজেলাকে বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ হিসেবে চেনে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও চীনের একটি গবেষণা দলের সহায়তায় খননকাজের মধ্য দিয়ে এখানে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি সময়ের ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার স্থাপত্যশৈলী খুঁজে পাওয়া যায়।
২০১৪ সালের শেষদিকে নাটেশ্বরে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে মাত্র চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে উৎখনন কাজের মধ্য দিয়ে মাটি খুঁড়লে একে একে বেরিয়ে আসে বৌদ্ধ মন্দির, অষ্টাকোণাকৃতি স্তূপ, পাকা দেয়াল, যাতায়াতের রাস্তার অংশবিশেষ।
এরই ধারাবাহিকতায় দৃশ্যমান হয় প্রাচীন বৌদ্ধ নগরী। বৌদ্ধ নগরী পরিদর্শনকালে চীনের রাষ্ট্রদূত মি. মা মিয়াংচ্যাং বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চিরকাল অক্ষুন্ন থাকবে।
এখানে দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও জেলার শহর-শহরতলি থেকে আগত পর্যটক ও ছুটির দিনে ভ্রমণপিপাসুরা ঘুরতে এসে বলেন, বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কার বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আবিষ্কৃত নগরীর সঙ্গে শ্রীজ্ঞান তাপস অতীশের সম্পর্ক নিবিড় মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে প্রতœ-উৎখনন কাজের গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সুপ্রাচীন বৌদ্ধ নগরীর সঙ্গে দ্বিতীয় গৌতম বুদ্ধ শ্রীজ্ঞান তাপস অতীশ দীপংকরের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
ইতিহাসবিদের অনেকে ধারণা দিয়েছেন, অতীশ দীপংকর বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বৌদ্ধবিহার নালন্দায় অধ্যয়ন করেন।
পরে তিনি বিক্রমশীল মহাবিহারের অধ্যক্ষের নিয়োগ পেয়েছিলেন।
এক সময় তিনি সোমপুর মহাবিহারেও অধ্যক্ষ ছিলেন।
বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয় রোধে রাজা চং ছপের আমন্ত্রণে অতীশ দীপংকর তিব্বতে গমন করেন ও সেখানে ১৬ বছর অবস্থানকালে ১৭৫টি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন।
তার জš§ভূমি বজ্রযোগিনী থেকে রামপাল হয়ে নাটেশ্বর অব্দি প্রতœ-খননের মধ্য দিয়ে যে প্রাচীন বৌদ্ধ নগরী দৃশ্যমান হয়েছে আমাদের চোখের সামনে, হাতের নাগালেÑতা নিঃসন্দেহে এ সমতট অঞ্চলের ইতিহাসবিদদের জন্য অবশ্যই সুখবর।
আবার এটাও সত্যি যে, মহাপুরুষ অতীশ নিজ জš§ভূমে অবহেলিত ও শেকড়ছিন্ন। সম্প্রতি চীন সরকারের সহায়তায় বজ্রযোগিনীতে অতীশ দীপংকরের বাস্তুভিটায় তার ভগ্ন দেহাবশেষ আনা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে অতীশের স্মৃতিস্তম্ভ।
বলা যায়, শ্রীজ্ঞান তাপস অতীশ বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে মৈত্রীর সেতুবন্ধন রচনা হয়েছে নতুন করে। স্মৃতিস্তম্ভে খোদাই করা স্মারকে রোমান ও চৈনিক লিপিতে লেখা রয়েছেÑহাজার বছর আগে অতীশ দীপংকর চীনে শুধু বৌদ্ধ ধর্মেরই সংস্কার করেননি, তিনি চীনে কৃষি ও ঔষধি প্রযুক্তির প্রসারও ঘটিয়েছেন।
কথিত আছে, অতীশ দীপংকরের সময় (৯৮২-১০৪৫ সাল) বিক্রমপুরের বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রে নেপাল, তিব্বত, চীন, থাইল্যান্ডসহ অন্য দেশের আট হাজার শিক্ষার্থী ও ১০০ শিক্ষক ছিলেন।
বলা বাহুল্য, ওই শিক্ষাকেন্দ্রের অধ্যক্ষ ছিলেন অতীশ দীপংকর।
ঘুরে আসুন মুন্সীগঞ্জে বৌদ্ধ নগরী:-
হাজার বছর আগের পুরাকীর্তির সঙ্গে সময় কাটানো যে কাউকে প্রলুব্ধ করবে। উৎসব কিংবা ছুটির অবসরে ইতিহাসের ভাবনায় পেয়ে বসলে ছুটে আসতে পারেন এখানে।
ইতিহাস জানার মধ্য দিয়ে মেধা, মন-মনন-মননশীলতাকে শানিত করে নিতে ঘুরে আসুন অর্মত্য সেনের বিক্রমপুরে। ইতিহাসকে জানুন আর সত্যেন সেন, সরেজেনু নাইডু, বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, হুমায়ুন আজাদের মুন্সীগঞ্জকে দেখুন নিজ চোখে।
যেভাবে যাবেন:-
রাজধানীর গুলিস্তান বা ফুলবাড়িয়া চৌরাস্তা থেকে বাসে চড়ে চলে আসুন মুন্সীগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠ মুক্তারপুর এলাকায় ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর পাদদেশে। বাসে টিকিট কাটতে খরচ হবে ৫৫ থেকে ৭০ টাকা।
মুক্তারপুরে সেতুর পাদদেশ থেকে রিকশায় অতীশের জš§ভূমি বজ্রযোগিনীর বাস্তুভিটায় যেতে ভাড়া লাগবে মাত্র ১০০ থেকে দেড়শ টাকা। অটোরিকশায় একই খরচ পড়বে।
টঙ্গিবাড়ীর বজ্রযোগিনী ও রঘুরামপুরের অবস্থান কাছাকাছি। কাজেই রঘুরামপুরের বৌদ্ধবিহারে যেতে খরচের অংকটা বাড়বে না।
বৌদ্ধ নগরীর চোখ ধাঁধানো বৌদ্ধ মন্দির তথা জেলার টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বর যেতে হলে প্রথমে একই পরিবহনে মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের মুক্তারপুরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুতে আসতে হবে।
মৈত্রী সেতু থেকে টেম্পো বা স্কুটারে মাত্র ৫০ টাকা খরচে চলে যান নাটেশ্বরে।
তাছাড়া রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে ১০০ থেকে দেড়শ টাকা খরচে আপনি চলে আসতে পারেন হাজার বছরের প্রত্ন-নিদর্শন নগরীতে।
শেখ মোহাম্মদ রতন / ০১৮১৮৩৩৬৮০৮ / ২৭-০৪-১৮/ সমকালীন মুন্সীগঞ্জ